![]() |
আজকাল খাদ্য বিষক্রিয়া একটি বড় ধরনের সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ধরনের সমস্যা বিভিন্ন ধরনের খাবার খাওয়ার কারণে হতে পারে। ইংল্যান্ডের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের মতে, খাবারের বিষক্রিয়া বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গুরুতর নয় এবং এটি এক সপ্তাহের মধ্যেই ভালো হয়ে যায়। তবে, অল্প সংখ্যক সমস্যা জটিল হতে পারে।
খাদ্য বিষক্রিয়া কি?
বিবিসির গুড ফুড রিপোর্ট করেছে যে, বিভিন্ন ধরণের জীবাণু খাদ্য বিষক্রিয়া সৃষ্টি করে। তবে, এটি প্রায়শই শারীরিক সমস্যার কারণেও হতে পারে যেমন অতিরিক্ত অ্যালকোহল সেবন বা শরীরে অ্যালার্জি থাকলে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) খাদ্যজনিত অসুস্থতাকে বিষাক্ত এবং সংক্রামক জীবাণু দ্বারা সৃষ্ট একটি রোগ হিসাবে বর্ণনা করে যা খাদ্য ও পানীয়ের মাধ্যমে আমাদের শরীরে প্রবেশ করে। এটি বিভিন্ন ধরণের ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া এবং পরজীবী দ্বারাও হতে পারে।
এগুলো কি ধরনের?
বিভিন্ন ধরণের খাদ্য বিষক্রিয়া রয়েছে। এই ধরনের সমস্যা বিভিন্ন ধরনের ভাইরাস এবং ব্যাকটেরিয়ার কারণে হতে পারে। আসুন কারণগুলি খুঁজে বের করার চেষ্টা করি-
ক্যাম্পাইলব্যাক্টর ব্যাকটিরিয়া: ক্যাম্পাইলোব্যাক্টর নামক ক্ষতিকর ভাইরাসের কারণে খাদ্যে বিষক্রিয়া সবচেয়ে বেশি হয়। কাঁচা এবং আধা সেদ্ধ মাংস খাওয়ার ফলে এই ব্যাকটেরিয়াগুলো আমাদের শরীরে প্রবেশ করে। এটি অপরিশোধিত পানি এবং অপাস্তুরিত দুধ যা সঠিকভাবে সিদ্ধ করা হয়নি তা পান করার কারণেও হতে পারে। শরীরে ব্যাকটেরিয়া প্রবেশের ৩ থেকে ১০ দিনের মধ্যে লক্ষণ দেখা দেয়। সুস্থ হতে এক সপ্তাহ পর্যন্ত সময় লাগতে পারে কিন্তু রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হলে মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে।
লিস্টারিয়া মনোকাইজোজেনিক ব্যাকটিরিয়া: খাবারের জন্য আগে থেকে প্রস্তুত করা এমন খাবারে এই ধরনের ব্যাকটেরিয়ার উপদ্রব বেশি দেখা যায়। এই ধরনের ব্যাকটেরিয়া ফাস্ট ফুড, রান্না করা মাংস এবং তৈলাক্ত খাবারে আক্রমণ করে। এই ধরনের ব্যাকটেরিয়া বয়স্ক মানুষ, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম এবং গর্ভবতী মায়েদের জন্য ঝুঁকির কারণ হতে পারে।
সালমোনেলা এবং ই কলাই ব্যাকটিরিয়া: এই ধরণের ব্যাকটেরিয়া মাংস সঠিকভাবে রান্না করা হয়নি, কাঁচা ডিম, দুধ এবং দুগ্ধজাত খাবারে বেশি দেখা যায়। শরীরে ব্যাকটেরিয়া প্রবেশের ১২ থেকে ৭২ ঘন্টার মধ্যে রোগের লক্ষণ দেখা দেয়। জ্বর, বমি বমি ভাব, পেটে ব্যথা, ডায়রিয়া এই রোগের কিছু প্রধান লক্ষণ।
শিগেলা ব্যাকটেরিয়া: দূষিত পানি দিয়ে যেকোনো খাবার ধোঁয়ার কারনে ভাইরাস এবং ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ হতে পারে। ব্যাকটেরিয়া শরীরে প্রবেশের ৩ থেকে ৭ দিন পর এই রোগ হয়। প্রধান উপসর্গ হল বমি বমি ভাব এবং ডায়রিয়া। এই সমস্যা ৩-৭ দিন স্থায়ী হয়।
ক্লোস্ট্রিডিয়াম পারফ্রিজেন ও ব্য্যাসিলাস সেরিয়াস ব্যাকটিরিয়া: এই ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের ফলে অন্ত্রের প্রদাহ, বমি এবং ডায়রিয়া হতে পারে। রান্না করা খাবারে ২ ঘণ্টারও বেশি সময় পর এই ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি ঘটে। তাই খাওয়ার আগে খাবার সবসময় গরম করা উচিত।
বটুলিসম ব্যাকটিরিয়া: ক্লোস্ট্রিডিয়াম বটুলিনাম ব্যাকটেরিয়া নামক একটি মারাত্মক ব্যাকটেরিয়া দ্বারা এই ধরনের রোগ হয়। সাধারণ লক্ষণগুলি হল বমি এবং ডায়রিয়া এবং গুরুতর সংক্রমণে শরীরের বিভিন্ন অংশে প্যারালাইসিস হতে পারে। কিন্তু সময় লাগলেও একটা সময় এগুলো সেরে যায়।
কোন খাবারের দিকে বিশেষ মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন?
বিবিসির গুড ফুডের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যেকোনো দূষিত খাবার থেকে স্বাস্থ্য ঝুঁকি রয়েছে। তবে কিছু খাবারের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেওয়া উচিত।
মাংস: কাঁচা মাংস সবচেয়ে বেশি ব্যাকটেরিয়া দ্বারা আক্রান্ত হয় তাই এটি ভালোভাবে রান্না করে খাওয়া উচিত। তবে, রান্নার আগে, অন্যান্য খাবারে ব্যাকটেরিয়া ছড়ানোর ঝুঁকি কমাতে মাংস পরিষ্কার পানি দিয়ে খুব ভালোভাবে ধুয়ে নিতে হবে। সঠিকভাবে ধোয়া মাংস ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা কমায় এবং কিছুটা নিরাপদ। সঠিক তাপে ভালোভাবে রান্না করলে এই ব্যাকটেরিয়া মারা যায়।
ফল এবং শাকসবজি: ফল এবং শাকসবজি পরিষ্কার পানি দিয়ে খুব ভালোভাবে ধুয়ে ফেলতে হবে। কোনো ধরনের মাটি বা বালি যেন না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এর কারণ হল এই মাটি বা বালির কণার মাধ্যমে ই-কলাই ভাইরাস ছড়াতে পারে। এজন্য কাঁচা সবজির সালাদ তৈরির সময় এদিকে বিশেষ যত্ন নেওয়া উচিত।
অপরিশোধিত চাউল: বিবিসি গুডফুড রিপোর্ট করেছে যে, ধোয়া হয়নি এমন চাউলে ব্যাসিলাস ক্যারিয়াস নামে একটি ব্যাকটেরিয়া রয়েছে যা খাদ্য বিষক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। সঠিক তাপমাত্রায় রান্না করার পরও এই ধরনের ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস হয় না। রান্না করা ভাত ঠান্ডা হলেই এই ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ আরও বৃদ্ধি পেতে থাকে। ব্যাকটেরিয়ার মাত্রা বাড়ার সাথে সাথে শক্তিশালী টক্সিন তৈরি হয় যা বমি ও ডায়রিয়ার কারণ হতে পারে। রান্না করার ১ ঘন্টা পরে সেই খাবার খাওয়ার জন্য উপযুক্ত নয়। তাই খাবারের জন্য যতটা প্রয়োজন ঠিক ততটুকুই রান্না করা ভালো।
অঙ্কুরিত মটরশুটি: প্রক্রিয়াজাত না হওয়া অঙ্কুরিত মটরশুঁটি কিনবেন না। রান্না করার আগে পরিষ্কার পানি দিয়ে খুব ভালোভাবে ধুয়ে নিতে হবে এবং পর্যাপ্ত তাপে রান্না করে খেতে হবে।
শিমের বীজ: লাল রঙের শিমের বীজে প্রাকৃতিকভাবেই ফাইটোহায় ম্যাগ গ্লুটিনিন থাকে যা লেকটিন নামে পরিচিত এবং এটি খাদ্য বিষক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। এই ধরনের খাবার কিছুক্ষণের জন্য পরিষ্কার পানিতে ভিজিয়ে রাখা উচিত এবং তারপর সঠিক তাপমাত্রায় ভালোভাবে রান্না করা উচিত। এটি প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট জীবাণু ধ্বংস করবে।
এছাড়াও, ফল এবং শাকসবজি কীটনাশক ব্যবহার করে পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণ করা হয়। নির্ধারিত সময়ের আগে ওই খাবারগুলো খেলে এইধরনের বিষক্রিয়ার সমস্যা হতে পারে।
কিভাবে আপনি পেট খারাপের সমস্যা এড়াতে পারেন?
১/ পোষা প্রাণী ধরা, ময়লা ধরার পর বা টয়লেট থেকে বেরিয়ে এসে সাবান দিয়ে ভালো করে হাত না ধুয়ে কোন খাবার স্পর্শ করা উচিত নয়।
২/ মেয়াদোত্তীর্ণ কোনো খাবার খাওয়া যাবে না। খাবার কেনার আগে সর্বদা মেয়াদ শেষ হওয়ার তারিখ দেখে নিন।
৩/ সর্বদা নির্ধারিত তাপমাত্রায় খাবার সংরক্ষণ করুন। খাবার রান্নার পর ২ দিনের মধ্যে খাওয়া শেষ করতে হবে।
৪/ আমরা যেখানে খাবার রান্না করি বা প্রস্তুত করি সেই জায়গাটি গরম পানি বা সাবান দিয়ে ভালোভাবে পরিষ্কার করুন। বিশেষ করে মাছ বা মাংস ধোয়ার পর খুব ভালোভাবে ধুয়ে নেওয়া জরুরি।
৫/ কোন পোষা প্রাণীকে রান্না বা খাবার তৈরির এলাকায় প্রবেশ করতে দেওয়া উচিত নয়। যদি পোষা প্রাণী কোনোভাবে রান্নাঘরে প্রবেশ করে, তাহলে তা গরম পানি বা সাবান দিয়ে ভালোভাবে পরিষ্কার করুন।
৬/ খাবার কখনই খোলা রাখা উচিত নয় এবং প্যাকেট খোলার পর ২ ঘন্টার বেশি রাখা উচিত নয়।
৭/ কম তাপে রান্না করা খাবার কখনই খাবেন না। সবসময় খাবারের আগে সঠিক তাপমাত্রায় খুব ভালোভাবে গরম করুন।
৮/ হোটেল বা রেস্তোরাঁয় খাওয়ার আগে নিশ্চিত হয়ে নিন যে সেখানের পরিবেশ এবং খাবার স্বাস্থ্যকর কিনা।